বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ১১তম আসরের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ফরচুন বরিশাল। শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে চিটাগং কিংসকে ৩ উইকেটে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জিতেছে তামিম ইকবালের দল।
চিটাগং কিংস প্রথমে ব্যাট করে ১৯৩ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়ে। জবাবে ফরচুন বরিশাল ৩ বল হাতে রেখেই জয় নিশ্চিত করে।
বরিশালের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার রিশাদ হোসাইন, যিনি ৬ বলে ১৮ রানের মূল্যবান ইনিংস খেলেন। অধিনায়ক তামিম ইকবাল ২৯ বলে ৫৪ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরার পুরস্কার অর্জন করেন।
কিছুদিন আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া তামিম ইকবালকে ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়, যা ফাইনাল ম্যাচের আবেগঘন মুহূর্তগুলোর একটি হয়ে থাকবে।
বিপিএলের ১১তম আসরের সমাপ্তি ছিল গোছানো ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, যেখানে ক্রিকেটীয় লড়াই দর্শকদের উপভোগ্য মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। তবে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে নানা বিতর্ক সামনে এসেছে।
ক্রিকেটারদের পাওনা পরিশোধ না করা, হোটেল রুমে এক দলের মালিককে অবরুদ্ধ রাখার ঘটনা এবং ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে গুঞ্জন—সব মিলিয়ে এবারের বিপিএল নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। এসব বিতর্ক টুর্নামেন্টের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যা ভবিষ্যতে বিপিএল আয়োজন নিয়ে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বিপিএলে আবারও পেমেন্ট বিতর্ক, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমালোচনার ঝড়
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ১১তম আসরে পেমেন্ট ইস্যু সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে। ক্রিকেটার থেকে শুরু করে হোস্ট—প্রত্যেকেই আর্থিক লেনদেন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বিষয়টি এতটাই তোলপাড় সৃষ্টি করেছে যে ফরচুন বরিশালের হয়ে খেলা দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার জেমস ফুলার ইনস্টাগ্রামে ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট করেন—"গ্লাভস ও ব্যাট পেলাম, ধন্যবাদ।" তার কমেন্টে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার বেন কাটিং জিজ্ঞাসা করেন, "গ্লাভস, প্যাড পেয়েছ ভালো কথা, পেমেন্ট পেয়েছো?"
পেমেন্ট ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে ফাইনালিস্ট চিটাগং কিংস ও দুর্বার রাজশাহী।
চিটাগং কিংসের মালিক সামির কাদের চৌধুরী জাতীয় দলের ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমনকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন—"ও আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।" অথচ ইমন পুরো আসরে ১৩ ম্যাচে ৩৩৮ রান করার পাশাপাশি ফাইনালেও ৪৯ বলে ৭৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন।
অন্যদিকে, দুর্বার রাজশাহীর কিছু বিদেশি খেলোয়াড় পেমেন্ট না পাওয়ায় কর্মবিরতি পালন করেন, যার ফলে এক ম্যাচে পুরোপুরি দেশি স্কোয়াড নিয়ে খেলতে হয় রাজশাহীকে।
এমন বিতর্কিত পরিস্থিতির মধ্যে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী টম মফেট ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "টাকা না দেওয়ার দিক থেকে বিপিএল বারবার একই অপরাধ করে যাচ্ছে।"
এখানেই শেষ নয়। টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো ক্রিকেটারদের দেওয়া চেক একাধিকবার বাউন্স করেছে। এমনকি পেমেন্ট সংক্রান্ত জটিলতার কারণে হোটেল কর্তৃপক্ষ দুর্বার রাজশাহীর মালিককে একপর্যায়ে আটকে রেখেছিল।
চাপ সামলাতে না পেরে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্বার রাজশাহীর অধিনায়ক তাসকিন আহমেদ মন্তব্য করেন, "দোয়া কইরেন যাতে চেক বাউন্স না হয়।"
এছাড়া চিটাগং কিংসের হোস্ট ইয়াশা সাগর অভিযোগ করেন, তাকে পূর্ণ পেমেন্ট দেওয়া হয়নি। তার ম্যানেজার জানিয়েছেন, "চুক্তির বাইরে বিজ্ঞাপনে কাজ করতে চাপ দেওয়া হয়েছে, অথচ প্রতিশ্রুত অর্থের মাত্র ৫৫% পরিশোধ করা হয়েছে।"
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপিএলের অন্যতম আলোচিত চরিত্র ছিলেন ইয়াশা, যার পেমেন্ট ইস্যু নিয়েও তুমুল আলোচনা হয়েছে।
এই বিতর্ক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ESPN Cricinfo-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এক ক্রিকেটারের এজেন্ট মন্তব্য করেছেন, "আইসিসির উচিত এসব বিষয় নজরে আনা। বড় বড় নাম সই করানো হয়, বিমানে ওঠার আগে কিছু অর্থ দেওয়া হয়, এরপর আর এক টাকাও দেওয়া হয় না।"
সর্বশেষ বাংলাদেশের ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখের মধ্যে সব ক্রিকেটারদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।
তবে বারবার একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি বিপিএলের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, যা ভবিষ্যতে বিদেশি ও দেশি ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
বিপিএলে ফিক্সিং বিতর্ক: সন্দেহের চোখে কিছু ম্যাচ ও ক্রিকেটার
বিপিএল ২০২৫-এ ম্যাচ ফিক্সিং ও দুর্নীতির অভিযোগ এতটাই তীব্র হয়েছে যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বিষয়টি তদন্ত করতে অ্যান্টি-করাপশন ইউনিটের (ACU) পাশাপাশি একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
মাঠের কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ক্রিকেটপ্রেমীদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। বিশাল ওয়াইড বল, মোহাম্মদ আমিরের ber স্মরণ করিয়ে দেওয়া নো বল, এবং কিছু বোলারের সন্দেহজনক পারফরম্যান্স বিতর্ক উসকে দিয়েছে।
এবারের আসরে এমন কিছু ক্রিকেটার খেলেছেন, যাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা প্রশ্নবিদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ার উইলিয়াম বোশিস্ট গত চার বছর কোনো স্বীকৃত প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেননি। একইভাবে, আফগানিস্তানের ফরমানুল্লাহ কখনো কোনো বিদেশি লিগে খেলেননি, শুধুমাত্র আফগানিস্তান 'এ' দলের হয়ে খেলেছেন।
কিছু নির্দিষ্ট মুহূর্তে বোলারদের রান দেওয়ার ধরণও সন্দেহ তৈরি করেছে। বিপিএল ২০২৫-এর অফিসিয়াল হোস্ট সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামি বলেছেন, "কিছু ওভারে এমনভাবে রান দেওয়া হয়েছে যে মনে হয়েছে, সেই রান নির্দিষ্টভাবে দেওয়া দরকার ছিল।"
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সামি বলেন,
"আমি কমেন্ট্রি বক্সে বসে সরাসরি ফিক্সিংয়ের অভিযোগ তুলতে পারি না, কারণ আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই। তবে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। কিছু বোলার এমন ফিল্ড সেটআপ রেখে বল করছিলেন যে সন্দেহ না করে উপায় নেই।"
তিনি আরও বলেন,
"দুই বল ডট হলে পরের বল ওয়াইড হয়ে পাঁচ রান দিয়ে দেওয়া, কোন বল ওয়াইড হবে তা আগেভাগে অনুমান করা যাচ্ছিল—এমন সব ঘটনা আমাদের চোখে পড়েছে।"
এছাড়া, উইকেটকিপারদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
"উইকেটকিপাররা এমন মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লিটন দাস, জাকের আলির মতো ক্রিকেটাররা যখন কিপিং করেননি, তখন কিছু বল অনায়াসে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা স্বাভাবিক মনে হয়নি।"
তবে, সামি এটাও মনে করেন যে কিছু খেলোয়াড় তাদের পেশাদারিত্ব এবং ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি রক্ষা করতে এসব বিতর্কের অংশ নেননি।
বিপিএলের ম্যাচ ফিক্সিং ইস্যু এবার আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচিত হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে হয়তো এসব অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।
বিপিএলে ইতিবাচক দিক: ছক্কার বৃষ্টি, রানের উৎসব, দর্শকদের আগ্রহ
বিপিএল ২০২৫-এ নানা বিতর্ক থাকলেও মাঠের ক্রিকেট ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও উপভোগ্য। বিপিএলের অফিসিয়াল হোস্ট সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামি মনে করেন, "৬০-৪০ অনুপাতে মাঠের ক্রিকেট ভালো ছিল। খেলার মান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়, তবে অতি আত্মবিশ্বাসেরও জায়গা আছে।"
এবারের আসরে সবচেয়ে বেশি ছক্কা ও শতক দেখা গেছে। ফাইনাল ও কোয়ালিফায়ার ম্যাচগুলোয় রানের বন্যা বয়ে গেছে, যা ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য উপভোগ্য ছিল।
সামি বলেন,
"সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে বিদ্রূপ করলেও মাঠে দর্শকরা দারুণভাবে খেলা উপভোগ করেছেন। ভিউয়ারশিপও ভালো ছিল, যা বিপিএলের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে।"
অনেকে মনে করেন, এবার বেশি রান আসার কারণ বাউন্ডারি ছোট হওয়া। এমনকি তামিম ইকবালও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
তবে সামি জানান, সিলেটে স্ট্রেইট বাউন্ডারির মাপ ছিল ৬৫ মিটার, যেখানে নিয়ম অনুযায়ী ৫৯-৮২ মিটারের মধ্যে থাকা যায়। ভারতে যেমন ব্যাঙ্গালোরের চিনাস্বামী স্টেডিয়ামের বাউন্ডারিও এর চেয়েও ছোট।
বাউন্ডারি ছোট হলেও ছক্কাগুলো ছিল বিশাল। ৭৫-৮০ মিটারের ছক্কা অহরহ দেখা গেছে, এমনকি আফিফ হোসেনের একটি ছক্কা ১০০ মিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে।
সবমিলিয়ে, মাঠের লড়াই, ব্যাটিং পারফরম্যান্স, এবং দর্শকদের আগ্রহ এবারের বিপিএলের অন্যতম ইতিবাচক দিক হিসেবে সামনে এসেছে।